অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
বাংলাদেশের পাবনার সন্তান ‘ডিসকো কিং’খ্যাত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার, সুরের জাদুকর, সুরকার, সংগীত পরিচালক বাপ্পী লাহিড়ী গতকাল বুধবার সকালে মুম্বাইয়ের সিটি কেয়ার হাসপাতালে দেহত্যাগ করেছেন।
বাপ্পী লাহিড়ীর শৈশব কেটেছে কলকাতায়। কিন্তু তিনি বোম্বে শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী চিত্রাণী, মেয়ে রেমা ও ছেলে বাপ্পা লাহিড়ীসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
কণ্ঠশিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী ১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর পিতা অপরেশ লাহিড়ীর কর্মস্থল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশর পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে। বাপ্পী লাহিড়ী ছিলেন পিতামাতার একমাত্র সন্তান। তার আসল নাম ‘অলকেশ লাহিড়ী’।
জীবিত থাকতে বাপ্পী লাহিড়ী অকপটে বলতেন, আমি বাংলাদেশের পাবনার সন্তান। বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যু সংবাদে পাবনার ফরিদপুরসহ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
বাপ্পী লাহিড়ীর সংগীত শিক্ষা শুরু শৈশব থেকে। পিতামাতার কাছেই তার সংগীতে হাতেখড়ি। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি পিতার সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে তবলা বাজান। তার স্বপ্ন পূরণ হয় ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ সংগীতের মাধ্যমে।
চীন থেকে সংগীতে পেয়েছেন ‘গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড’। ১৯ বছর বয়সে (১৯৭২) তিনি ‘দাদু’ নামক চলচ্চিত্রে প্রথম প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। ১৯৭৩ সালে হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘নানহা শিকারি’ ছবিতে তিনি প্রথম সুরারোপ করেন। তার সংগীত ভুবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় তাহির হুসেনের ‘জখমী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এতে তিনি গীত রচনাসহ গায়কের দ্বৈত ভূমিকায় অংশ নেন।
‘অসম্ভব কিছু নয়’ শিরোনামে মোহাম্মদ রফি এবং কিশোর কুমারের সঙ্গেও দ্বৈত সংগীতে অংশ নেন তিনি। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘চলতে চলতে’ চলচ্চিত্রে বিশেষ স্বীকৃতি পান। তার সুরারোপ করা সংগীত ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা, কাভি আলবিদা না কাহে না’ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মিঠুন চক্রবর্তীর ডিসকো নাচের চলচ্চিত্রগুলোতে বাপ্পী লাহিড়ী ছিলেন একজন সুযোগ্য সংগীত পরিচালক। ৮০-এর দশকের ভারতীয় ডিসকো সংস্কৃতিতে মিঠুন চক্রবর্তী এবং বাপ্পী লাহিড়ী ছিলেন একে-অপরের পরিপূরক। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে পরিচালিত অনেক হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে অংশ নিয়েছেন সমানতালে।
সমগ্র ভারববর্ষে তিনি নিজেকে ‘ডিসকো কিং’ নামে পরিচিতি লাভে সক্ষম হন। বাপ্পী লাহিড়ী ভারতীয় চলচ্চিত্র জগত থেকে নব্বইয়ের দশকে দূরে সরে যান। প্রকাশ মেহরার ‘দালাল’ ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীর জন্য স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে আসেন। ‘গুটুর গুটুর’ গানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রটি ব্যাপকভাবে দর্শকদের মন জয় করে। গানে তিনি যথোপযুক্ত শব্দ প্রয়োগ ও সংগীত পরিচালনায় যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রে ও ভারতীয় ধাঁচে ‘ডিসকো সংগীত’ পরিবেশনের জন্য তিনি পথিকৃৎ হয়ে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল। তাঁর রচিত গানগুলো কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলের নৈপথ্য কণ্ঠসংগীতের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের পর্দায় এসেছে। বিজয় বেনেডিক্ট এবং শ্যারন প্রভাকরকেও তিনি সংগীতশিল্পে অভিষেক ঘটান। এছাড়াও তিনি আলিশা বিনয় এবং ঊষক উত্থাপকে তার সুরের ধারায় সিক্ত করতে ব্যবহার করেছেন।
বাপ্পী লাহিড়ীর সুরারোপিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : নানা শিকারি (১৯৭৩), জখমী (১৯৭৫), পাপী (১৯৭৭), ডিস্কো ড্যান্সার (১৯৮২), নিমক হারাম (১৯৮২), কামলা (১৯৮৪), কশম পয়দা করনেওয়ালি কি (১৯৮৪), শারাবি (১৯৮৪), গ্রেফতার (১৯৮৫), সাহেব (১৯৮৫), আজকা আরজুন (১৯৯০), ঘায়েল (১৯৯০), আই উইটনেস টু মার্ডার (১৯৯১), প্রেম প্রতিজ্ঞা (১৯৯১), বোম্বে গার্লস (২০০১), হামলা তুম হামারে হ্যায় জন্ম ইত্যাদি।
গীতের জন্য বাপ্পী লাহিড়ী পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। তার প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ সংগীত পুরস্কার-১৯৮৪, গোল্ডেন লোটাস পুরস্কার ইত্যাদি।
বাপ্পী লাহিড়ী সাধারণত তিনি পোশাকের সঙ্গে স্বর্ণের অলঙ্কার এবং কালো চশমা পরিধান করতেই বেশি ভালোবাসতেন এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
পাবনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর শিবজিত নাগ জানান, বাপ্পী লাহিড়ীর সঙ্গে আমাদের পাবনার এক যোগসূত্র আছে। উনার পিতা ও মাতা উভয়ের আদিনিবাস পাবনা জেলায়। পাবনা শহরের গোপালপুরের লাহিড়ী বাড়ির বাসিন্দারা উনাদের ঘনিষ্ঠজন।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কতিপয় সাংস্কৃতিক সতীর্থজনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রফেসর শিবজিত নাগ আরও বলেন, ২০০৮ এ উত্তর আমেরিকার বসবাসরত বাংলাদেশিদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ফেডারেশন ফোবানা (ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ডালাস শহরে। ওই সম্মেলনে বাপ্পী লাহিড়ী এসেছিলেন আমন্ত্রিত শিল্পী হিসাবে। যে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পাবনার মানুষ এ পরিচয় দিতে তিনি অত্যন্ত আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন।
বাপ্পী লাহিড়ীর পাবনায় আসার কোনো তথ্য নেই। তবে তার বাবা অপরেশ লাহিড়ী একাধিকবার পাবনায় এসেছেন। তিনি শহরের জুবিলী ট্যাংকপাড়ায় আত্মীয় বাড়িতে এসে উঠতেন।
ঢাকায় অবস্থানরত পাবনার ফরিদপুরের বিশিষ্ট লেখক গবেষক মো. মহিউদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, বাপ্পী লাহিড়ীর বাবা অপরেশ লাহিড়ী ১৯৪৭ এর আগেই কলকাতায় চলে যান। ফরিদপুরের গোপালনগরে গৌড়ি প্রসন্ন মজুমদার ও অপরেশ লাহিড়ীর বাড়ি পাশাপাশি। বর্তমানে ফরিদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অপরেশ লাহিড়ীর পৈতৃক বাড়ি।
এখনো ওই পরিবারের আত্মীয়স্বজন গোপালনগরে আছেন। তাদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাবলু লাহিড়ী। তিনি বর্তমানে অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ফরিদপুরে তাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বাপ্পীর মৃত্যু সংবাদে শোকের আবহ বিরাজ করছে।
0 Comments